বর্ডার হাট

বর্ডার হাট, কসবা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার হাট (Bangladesh-India Border Haat) একটি অনন্য বানিজ্য কেন্দ্র যা দুই দেশের যৌথ মালিকানায় পরিচালিত হয়। ২০১৫ সালের ১১ই জুন এই বর্ডার হাটের উদ্বোধন করা হয়, যা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্তের ২০৩৯ নং পীলার সংলগ্ন তারাপুর-কমলাসাগর সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। এটি শুধু একটি বানিজ্য কেন্দ্র নয়, বরং দুই দেশের মানুষের জন্য একটি মিলন মেলা হিসেবেও পরিচিত।

বর্ডার হাটের প্রতিষ্ঠা ও উদ্দেশ্য

বর্ডার হাটের মূল উদ্দেশ্য হলো সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা। সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে এই হাটে দুই দেশের মানুষ বিভিন্ন পণ্য কেনা-বেচার সুযোগ পান। এটি একটি অনন্য উদ্যোগ যা দুই দেশের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্ডার হাটের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদের মধ্যে একটি আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হয়।

বর্ডার হাটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম

বর্ডার হাটে ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই সীমান্তবর্তী ৫ কিলোমিটার এলাকার মানুষের প্রবেশের অনুমতি থাকে। তবে আশেপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরাও এখানে আসেন এবং ভারতীয় পণ্য ক্রয় করেন। হাটে বাংলাদেশের ১৫টি এবং ভারতের ১৬টি বিভিন্ন ধরণের পণ্যের কেনা-বেচা হয়। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা খোলা জায়গায় দুই পাশে ২৫টি করে মোট ৫০টি টিন শেডের দোকান রয়েছে।

হাটের পণ্যসমূহ

বর্ডার হাটে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনা-বেচা হয়। এখানে আপনি পাবেন কসমেটিকস, কাপড়-চোপড়, শাকসবজি, ফলমূল, মশলা জাতীয় পণ্য, বনজ ও কুটির শিল্পে উৎপাদিত দ্রব্য, কৃষি পণ্য, চা, অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী, চকলেট, শুকনো খাবারসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। এই পণ্যগুলো দুই দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং চাহিদাপূর্ণ।

বর্ডার হাটের অর্থনৈতিক প্রভাব

বর্ডার হাটের মাধ্যমে প্রতি ছয় মাসে প্রায় দুই কোটি থেকে আড়াই কোটি টাকার ভারতীয় ও বাংলাদেশী পণ্য কেনাবেচা হয়ে থাকে। এটি স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্ডার হাটের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য বিক্রি করে উপার্জন করেন এবং নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয় এবং মানুষের জীবনের মান উন্নয়ন ঘটে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক

বর্ডার হাটের মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে এবং তারা একে অপরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারেন। এটি দুই দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি করে।

বর্ডার হাটের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বর্ডার হাটের সফলতা সত্ত্বেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা, পরিবহন ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন এসব ক্ষেত্রে আরও উন্নতি প্রয়োজন। তবে সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব এবং বর্ডার হাটের আরও উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্ডার হাটের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল। সরকারের উদ্যোগ ও স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় এই হাটের পরিসর ও কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্ডার হাটের মাধ্যমে দুই দেশের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে এবং এটি একটি আদর্শ বানিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সোহাগ, তিশা, তিতাস, রয়েল কোচ, বিআরটিসি কিংবা সোহাগ পরিবহণের বাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর থেকে বাস/সিএনজি দিয়ে কসবা পৌরশহরে হয়ে পায়ে হেঁটে তাঁরাপুর সীমান্তের বর্ডার হাটে পৌঁছাতে পারবেন। এছাড়া ঢাকা বা কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রেনে কসবা রেলষ্টেশনে নেমে কয়েক মিনিট পায়ে হেঁটেই তারাপুর-কমলা সাগর সীমান্ত হাট যেতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সড়ক বাজার ও জগৎ বাজারে হোটেল সাগর, হোটেল সৈকত, হোটেল স্টার, আশিক প্লাজা, অবকাশ আবাসিক হোটেল, রহমান আবাসিক, চন্দ্রিমা প্রভৃতি আবাসিক হোটেল রয়েছে।

কোথায় খাবেন
বর্ডার হাটে যাওয়ার পথে খুচরা চা নাস্তার দোকান নজরে পড়বে। এছাড়াও কসবা উপজেলায় খাওয়ার জন্য ভালো মানের বেশ কিছু রেস্তোরা রয়েছে।

বর্ডার হাট সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ
অক্টোবর-মার্চ মাস প্রতি রবিবার এবং এপ্রিল-সেপ্টেবর মাস প্রতি মঙ্গলবার সকাল ১০ টা থেকে ৪টা পর্যন্ত বর্ডার হাট চালু থাকে। হাটে প্রবেশের জন্য বিজিবি সীমানায় নাম নিবন্ধন করে পরিচয় পত্র বা টোকেন নিতে ৩০ টাকা দিয়ে টিকেট কাটতে হয়। টিকেট সংগ্রহের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি বা জন্ম নিবন্ধন কার্ড প্রয়োজন হয়। বেলা ১১ টার আগে সীমান্ত হাট, উপজেলা পরিষদ ও বিজিবি ক্যাম্প থেকে টিকেট পাওয়া যায়। প্রতি হাটের জন্য কেবল ১০০০ টিকেট বরাদ্দ থাকে। তাই সকাল সকাল টিকেট সংগ্রহ করার চেষ্টা করুন। বর্ডার হাটে সরকারী ভাবে দুইশত ডলার পর্যন্ত পণ্য কেনার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ঢাকা থেকে এক দিনের ট্যুরে কসবা বর্ডার হাট ঘুরে দেখে কাছেই অবস্থিত আখাউরা ইন্ট্রিগ্রেট্রেড চেক পোস্টে চলে যেতে পারেন। এখানে বিকেল বেলা দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মনোমুগ্ধকর প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত দর্শকদের প্যারেড দেখার জন্য বসার সু-ব্যবস্থা রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দর্শনীয় স্থান
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে কালভৈরব মন্দির, কেল্লা জামে মাজার, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধি, ধরন্তি হাওর, হরিপুর জমিদার বাড়ি ও ঘাগুটিয়ার পদ্মবিল অন্যতম।

Similar Posts

  • কেল্লা শহীদ মাজার

    ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার খড়মপুরে অবস্থিত হজরত সৈয়দ আহম্মদ (রঃ) এর দরগাহ শরীফটি কেল্লা শহীদ মাজার (Kella Shahid Mazar) নামে সারা বাংলাদেশে পরিচিত। এই মাজারের পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কাহিনী, যা আজও মানুষকে আকৃষ্ট করে।তৎকালীন আগরতলা রাজ্যের মহারাজা দরগা শরীফ প্রতিষ্ঠার জন্য ২৬০ একর জমি দান করেন। আবার অনেকের মতে, হযরত শাহ…

  • কালভৈরব মন্দির

    ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিতাস নদীর কূল ঘেঁষে অবস্থিত কালভৈরব মন্দির (Sri Sri Kal Bhairab Temple) একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক হিন্দু তীর্থস্থান। শহরের মেড্ডা এলাকায় এই মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এবং এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। মন্দিরটি তার ২৮ ফুট উচ্চতার কালভৈরব মূর্তির জন্য বিখ্যাত, যা ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক উচ্চতার মূর্তি হিসেবে পরিচিত।…

  • আবি রিভার পার্ক

    ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে ভাদুগরে কুড়ুলিয়া খালের তীরে অবস্থিত এক অপূর্ব বিনোদন কেন্দ্র, যা সবাই চেনে আবি রিভার পার্ক (Abi River Park) নামে। প্রায় ৪৮০ শতক জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই পার্কটি তার নান্দনিক আয়োজন এবং মনোমুগ্ধকর পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই শিশুপার্কটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এক অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। আবি…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *