সাজেক ভ্যালি
বাংলাদেশের মধ্যে অপরিসীম সৌন্দর্যের মধ্যে সাজেক ভ্যালি একটি অমূল্য আকর্ষণ। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত এই স্থানটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন হিসাবে খ্যাত। এই লেখাটির মাধ্যমে আমরা সাজেক ভ্যালির মহৎ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভ্রমণের নির্দিষ্ট সময়, সহজ যাতায়াতের উপায়, এবং ভ্রমণকারীদের জনপ্রিয়তা নিয়ে আলোচনা করব।
সাজেক ভ্যালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি মহান অভিসার। এখানে ঘুরতে আসলে মানুষ পায় সাদা মেঘ, সবুজ পাহাড়, আবার আকাশের রঙ মিলিয়ে গেছে একটি নানা পরিচয়ের অদ্ভুত মহল। সাজেক ভ্যালির অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ১৮০০ ফুট। এই সার্বজনীন উচ্চতা থেকে অপরিসীম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়।

সাজেক ভ্যালির ভ্রমণের নির্দিষ্ট সময়
সাজেক ভ্যালি প্রতি সময়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আনন্দ অনুভব করার জন্য উপযুক্ত। বেশিরভাগ পর্যটক সাজেক ভ্যালি ভ্রমণ করতে প্রাথমিকভাবে বর্ষা ও শীতকালে আসেন। গরম ঋতুতে এখানে প্রাকৃতিক শীতলতা অনুভব করা যায়, যা প্রতিটি পর্যটকের চাহিদা সমন্বয়ে যাচ্ছে।
সাজেক ভ্যালি: সহজ যাতায়াতের উপায়
সাজেক ভ্যালি যেতে খুবই সহজ। খাগড়াছড়ি জেলা থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার এবং দীঘিনালা থেকে ৪০ কিলোমিটার। সবাধুভাবে পর্যটকদের সুবিধা করতে, সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলি নিয়মিত বাস ও গাড়ি পরিচালনা করে থাকেন। তাছাড়া, যেতে পারেন নিজেদের গাড়ি ভাড়া করে অথবা ট্রেনে এসে খাগড়াছড়ি স্টেশন থেকে লোকাল গাড়ি বা বাসে যেতে পারেন।
সাজেক ভ্যালি: ভ্রমণকারীদের জনপ্রিয়তা
সাজেক ভ্যালি প্রশংসিত হোটেল, রিসোর্ট, এবং ভালো খাবারের সুবিধা সরবরাহ করে। এখানে অবস্থানগুলি সবাইকে অভিজ্ঞতার আনন্দ দেয়, যেখানে তারা প্রাকৃতিক আনন্দের সাথে বিনোদন করতে পারেন। এছাড়া, ভ্রমণকারীদের জন্য পার্যটক অবকাঠামো প্রদান করে যা তাদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আরও সুন্দর ও মেমরেবল করে তুলে আনে।
কি দেখবেন
চারপাশে মনোরম পাহাড় সারি, সাদা তুলোর মত মেঘের ভ্যালি আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সাজেক এমনই আশ্চর্য্যজনক জায়গা যেখানে একই দিনে প্রকৃতির তিন রকম রূপের সান্নিধ্যে আপনি হতে পারেন চমৎকৃত। কখনো বা খুব গরম অনুভূত হবে তারপর হয়তো হটাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যাবেন কিংবা চোখের পলকেই মেঘের ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাবে আপনার চারপাশ। প্রাকৃতিক নিসর্গ আর তুলোর মত মেঘের পাহাড় থেকে পাহাড়ে উড়াউড়ির খেলা দেখতে সাজেক আদর্শ জায়গা।
কংলাক পাহাড় হচ্ছে সাজেক ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। আর সাজেক ভ্যালির শেষ গ্রাম কংলক পাড়া লুসাই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। কংলাক পাড়া থেকেই কর্ণফুলী নদী উৎপত্তিস্থল ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। চাইলে রুইলুই পাড়া থেকে দুই ঘন্টা ট্রেকিং করে কমলক ঝর্ণা দেখে আসতে পারবেন। সুন্দর এই ঝর্ণাটি অনেকের কাছে পিদাম তৈসা ঝর্ণা বা সিকাম তৈসা ঝর্ণা নামেও পরিচিত।

সাজেক এর সূর্যোদয়
সাজেক এর সূর্যোদয়, ছবি
দিন কিংবা রাত সাজেক যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মত, সময় গড়ায় তবু সাজেক পুরাতন হয় না। সাজেকে গেলে অবশ্যই সকালে ভোরের সময়টা মিস করবেন না। মেঘের খেলা আর সূর্যোদয়ের আলোর মেলা এই সময়েই বসে। এই জন্যে আপনাকে খুব ভোরে উঠে চলে যেতে হবে হ্যালিপ্যাডে, সেখান থেকেই সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয় দেখা যায়। বিকেলের কোন উঁচু জায়গা থেকে সূর্যাস্তের রঙ্গিন রূপ আপনাকে বিমোহিত করবেই। আর সন্ধ্যার পর আকাশের কোটি কোটি তারার মেলা, আপনার প্রাণ জুড়িয়ে দিবে নিমিষেই। আকাশ পরিস্কার থাকলে দেখা পাবেন মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথের।
কখন যাবেন
সাজেকের রূপের আসলে তুলনা হয় না। সারা বছরই বর্ণিল সাজে সেজে থাকে সাজেক। বছরের যে কোন সময় আপনি সাজেক ভ্রমণ করতে পারেন। তবে জুলাই থেকে নভেম্বর মাসে সাজেকের চারপাশে মেঘের খেলা দেখা যায় বেশি। তাই এই সময়টাই সাজেক ভ্রমণের জন্যে সবচেয়ে ভালো।
সাজেক যাবার উপায়
সাজেকের অবস্থান রাঙামাটি জেলায় হলেও খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা হয়ে সাজেক যাতায়াত অনেক সহজ। তাই প্রথমেই আপনাকে খাগড়াছড়ি আসতে হবে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যেতে চাইলে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সৌদিয়া, সেন্টমার্টিন হুন্দাই, ইম্পেরিয়াল এক্সপ্রেস, দেশ ট্রাভেলস, শ্যামলী, শান্তি পরিবহন, এস আলম, ঈগল ইত্যাদি বাসে করে যেতে পারবেন। নন এসি এইসব বাস ভাড়া ৭৫০-৮৫০ টাকা। এসি বাসে যেতে চাইলে সেন্টমার্টিন হুন্দাই রবি এক্সপ্রেস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, রিলাক্স ট্রান্সপোর্ট, শ্যামলী, দেশ ট্র্যাভেলস, ইকোনো সার্ভিস ১০০০ থেকে ১৬০০ টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক এর দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বরের কাছ থেকে জীপগাড়ি/চাঁন্দের গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে সাজেক ভ্যালি ঘুরে আসতে পারবেন। যাওয়া আসা সহ দুইদিনের জন্যে ভাড়া নিবে ৯,০০০-১০,৫০০ টাকা। এক গাড়িতে করে ১২-১৫ জন যেতে পারবেন। তবে লোক কম থাকলে অন্য কোন ছোট গ্রুপের সাথে কথা বলে শেয়ার করে গাড়ি নিলে খরচ কম হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সিএনজি দিয়ে সাজেক যেতে পারবেন। রিজার্ভ ভাড়া লাগবে ৪০০০-৫০০০ টাকা। তবে পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা বলে সিএনজি দিয়ে ভ্রমণ না করাই ভালো।
জীপ সমিতি ও পার্বত্য যানবাহন মালিক কল্যান সমিতি কর্তৃক খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাওয়ার ভাড়ার তালিকা
যাত্রার ধরণ পিক আপ গাড়ি জীপ (চাঁদের) গাড়ী
সাজেক যাওয়া ও আসা ৬,০০০ ৬,০০০
সাজেক ১ রাত্রি যাপন ৮,৩০০ ৭,৭০০
সাজেক ১ রাত্রি যাপন, আলুটিলা, রিচাং ঝর্ণা ও ঝুলন্ত ব্রিজ সহ ১০,৪০০ ৯,০০০
সাজেক ২ রাত্রি যাপন ১১,১০০ ৯,৬০০
সাজেক ২ রাত্রি যাপন, আলুটিলা, রিচাং ঝর্ণা ও ঝুলন্ত ব্রিজ সহ ১৩,২০০ ১১,৪০০
এছাড়া আপনি যদি একা বা ২-৩ জন হন তাহলে খাগড়াছড়ি শাপলা চত্ত্বর থেকে অনেক গ্রুপ পাওয়া যায়, সেখানে অন্য গ্রুপের সাথে কথা বলে তাদের সাথে শেয়ার করে যেতে পারবেন অথবা জিপ সমিতির অফিসে গেলে ওরা ম্যানেজ করে দিবে অন্য কোন গ্রুপের সাথে।
কোথায় থাকবেন
সাজেকে থাকার জন্যে প্রায় শতাধিক রিসোর্ট ও কটেজ আছে। এক রাতের জন্যে রুম নিতে রিসোর্ট ভেদে ১৫০০ টাকা থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া লাগবে। ছুটির দিনে যেতে চাইলে মাসখানেক আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখা ভালো, নয়তো ভালো রুম পাবার নিশ্চিয়তা কম। আর কম দামে থাকতে চাইলে আদিবাসী কটেজ গুলোতে থাকতে পারেন। এছাড়া বর্তমানে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নতুন নতুন অনেক কটেজ হয়েছে। সাজেকের সব কটেজ থেকেই মোটামুটি সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়।
সাজেকের রিসোর্ট ও কটেজ
রিসোর্ট রুংরাং (Resort RungRang) : সাজেকের বেস্ট রিসোর্ট গুলোর একটি রিসোর্ট রুংরাং। রিসোর্টে বসেই দিগন্তজোড়া সারি সারি পাহাড় এবং মেঘের উড়োউড়ি দেখার জন্য আদর্শ। নান্দ্যনিক ইন্টেরিওর ডিজাইনে সাজানো এই রিসোর্টে আছে ৪টি ডাবল এবং ৪টি কাপল রুম। ছুটির দিনে ডাবল বেড রুম ভাড়া ৩৫০০ টাকা এবং কাপল ২৮০০ টাকা। অন্য সকল দিনে ডাবল বেড রুম ভাড়া ২৮০০ এবং কাপল ২০০০ টাকা। রুংরাং রিসোর্ট ভ্রমণ গাইড ব্যবহারকারীদের জন্যে দিচ্ছে রুম বুকিং এ ৫-১০% ডিসকাউন্ট সুবিধা। বুকিং এর সময় রেফারেন্স হিসেবে আপনি ভ্রমণ গাইড ব্যবহারকারী বলুন আর উপভোগ করুন এই স্পেশাল অফার। বুকিং এর জন্যে যোগাযোগ নাম্বার: 01884-710 723, 01869-649 817

সাজেক এর খাওয়া দাওয়া
সব রিসোর্টে খাবার ব্যবস্থা আছে তাই আগেই রিসোর্টগুলোতে বলে রাখলে পছন্দমত রান্না করে দিবে সেক্ষেত্রে প্রতিবেলা প্রতিজন ১০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে আর মেনু হিসেবে পাবেন ভাত আলুভর্তা, মুরগীর মাংস ইত্যাদি। চাইলে রাতে বার বি কিউও করতে পারবেন। এছাড়া আদিবাসী ঘরেও খাওয়া যায়, আগে থেকেই বলে রাখতে হবে কি খাবেন, তাহলে রান্না করে দিবে। সাজেকে খুব সস্তায় পেঁপে, আনারস, কলা ইত্যাদি ফল পাবেন চেখে দেখতে ভুল করবেন না।
সাজেক ভ্রমণ টিপস
- সাজেকে অনেক জায়গায় বিদুৎ নেই, সোলার পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক রাখতে পারেন।
- সাজেকে শুধুমাত্র রবি, এয়ারটেল ও টেলিটক এর নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায়।
- সাজেক যাবার পথ অনেক আঁকাবাঁকা ও উঁচু নিচু, তাই এই পথ বিপদজনক। জীপের ছাঁদে ভ্রমনে সতর্ক থাকুন।
- সাজেক যেতে গাইডের প্রয়োজন হয় না।
- আদিবাসীদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি নিয়ে নিন। অনুমতি ছাড়া ছবি তুলবেন না।
- আদিবাসী মানুষজন সহজ সরল তাদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করুন ও তাদের কালচারের প্রতি সম্মান দেখান।
- ছুটির দিনে গেলে ঝামেলা এড়াতে আগে থেকেই (মাস খানেক) রুম বুকিং দিয়ে রাখুন।
- যাবার পথে কয়েক জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প আছে। সেখানে ভ্রমণকারী সদস্যদের কিছু তথ্য জমা দিতে হয়। নিরাপত্তার সার্থে তাদের সহযোগিতা করুন। সাথে করে নিজের জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি রাখুন।
- দুই তিন দিনের জন্যে গেলে গাড়ি বসিয়ে না রেখে, শুধু যাবার জন্যে গাড়ি ঠিক করুন, ফিরে আসার সময় অন্য কোন গাড়িতে আসুন কিংবা দিঘীনালা থেকে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে ফেরত আসতে পারবেন।
সমাপ্তি
সাজেক ভ্যালি একটি স্বর্গীয় স্থান, যেখানে প্রকৃতির অদ্ভুত সৌন্দর্য আপনাকে আনন্দ ও প্রশান্তির সাথে আবার ফিরে আসতে প্রেরিত করে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অদেখা হয়না কখনও, তাই সাজেক ভ্যালি একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
আমাদের পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ! আশা করি আপনি সাজেক ভ্যালির সৌন্দর্য আনন্দ পাচ্ছেন এবং আপনার পরবর্তী ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে সাহায্য পেয়েছেন। শুভ ভ্রমণ কামনা করি!